Description
পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ে এখন জুমখেত থেকে ধান তোলার মৌসুম। এরপর শুরু হবে তিল, সুতাসহ নানা শাকসবজি তোলার কাজ। কোথাও একটি পরিবার, আবার কোথাও ‘মালেয়্যা’র (গ্রামের সবাই একসঙ্গে বিনা পারিশ্রমিকে একজনের খেতের ধান তুলে দেওয়া) মাধ্যমে জুমের ধান তোলার কাজ চলছে।
কয়েক দিন পর শীতের আমেজ শুরু হবে। তখন সুগন্ধি জুম চালের পিঠার গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে আদিবাসী গ্রামগুলোতে। আধুনিকতার প্রভাবে অনেক রেওয়াজ উঠে গেলেও গ্রামীণ জনপদের আদিবাসীদের মধ্যে জুমের ধান তোলার পর সুগন্ধি চালের পিঠা আর জুমে উৎপাদিত ফল নিয়ে বরকে নিয়ে নববধূদের বাপের বাড়িতে যাওয়ার রেওয়াজ এখনো রয়ে গেছে।
চাকমা সার্কেলপ্রধান রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, ‘জুমচাষের সঙ্গে আদিবাসীদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জীবনযাপন জড়িত। জুমের ফসল ঘরে তোলার পর আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার রীতি গ্রামীণ জনপদে এখনো বিদ্যমান। এ ছাড়া পূজা-পার্বণের আয়োজনও এই সময় হয়ে থাকে।’
জুরাছড়ি উপজেলার মৈদং ইউনিয়নের গবছড়িমোন পাড়ার আনজল তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘আগে জুমে কবরক, কামারাং, দুপ পাট্টিগি, রাঙা পাট্টিগি, ধালু হামারাং, হরিঙ্গিবিনি, বান্দরঙবিনি, লক্ষ্মীবিনি, আমেই, বুপ্পোই, মুম্বোইসহ নানা ধরনের সুগন্ধি চালের ধান জুমখেতে চাষ করা হতো। সেসব ধানের ফলন কমে যাওয়ায় চাষিরা জুমে উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষ শুরু করেছেন। এ ছাড়া আগে জুমে মাটি কর্ষণের কোনো রেওয়াজ না থাকলেও এখন উচ্চফলনের আশায় মাটি কর্ষণ করা হচ্ছে। সার ও কীটনাশকও প্রয়োগ হচ্ছে জুমে। যা জুমচাষের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিকে বদলে দিচ্ছে।’
বরকল উপজেলার বড়হরিণা ইউনিয়নের শ্রীনগর গ্রামের দেবদত্ত চাকমা (৭৮) জানান, ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে পাহাড়ের ছোট গাছপালা লতাগুল্ম কেটে শুকানো হয়। তারপর মে-জুন মাসে সেগুলো পুড়িয়ে ছাই বানানো হয়। এরপর সামান্য বৃষ্টির পর ছাই মিশে মাটি নরম হলে দায়ের ফলায় গর্ত করে একসঙ্গে ধানসহ নানা ফসলের বীজ বপন করা হয়। তারপর দুই থেকে তিন মাস আগাছা পরিষ্কার করে স্থানভেদে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জুমের ধান তোলা শুরু হয়। আর তা চলে নভেম্বর পর্যন্ত। জুমখেতে ধান ছাড়াও কাপড় তৈরির তুলাসহ সব ধরনের সবজি এবং ‘সাবারাং’ নামে মসলাজাতীয় একধরনের পাতাও ফলে। সুগন্ধযুক্ত এই পাতা আদিবাসীদের খুবই প্রিয়।
রাঙামাটি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) পবন কুমার চাকমা বলেন, জুমচাষ দুর্গম পার্বত্য এলাকায় খাদ্যনিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তিনি জানান, প্রতি হেক্টর জুমচাষে এক দশমিক ৪৫ মেট্রিক টন ধান, দুই থেকে আড়াই মণ তিল, ছোট ধানি মরিচ দেড় থেকে দুই মণ, মিষ্টিকুমড়া ২৫০ থেকে ৩০০টি, মারফা নামের একজাতীয় শসা দুই মণ এবং অন্যান্য ফসল ও শাকসবজি উৎপাদন হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর তিন পার্বত্য জেলায় ১৭ হাজার ৬৩০ হেক্টর পাহাড়ে জুমচাষ হয়েছে। এর মধ্যে রাঙামাটিতে দুই হাজার ১৯৫ হেক্টর, বান্দরবানে নয় হাজার ৫০ হেক্টর এবং খাগড়াছড়িতে ছয় হাজার ৩৮৫ হেক্টর। গত বছর চাষ হয়েছিল ১৪ হাজার ৬৯১ হেক্টরে।